আজকের কাব্যটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর লেখন একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা কাগজের নৌকা।
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছে হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকা খানি।।
আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
মেঘের মতো হারায়ে দিশা
আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়---
কোথায় যাবে কিনারা নাই,
দিবস নিশি চলেছে তাই,
বাতাস এসে লাগিছে গায়ে,
জোছনা এসে পড়েছে পায়ে,
উড়িয়া কাছে গাহিছে পাখি,
মুদিয়া যেন এসেছে আঁখি,
আকাশ-মাঝে মাথাটি থুয়ে
আরামে যেন ভাসিয়া যায়।।
হৃদয় মোর মেঘের মত
আকাশ মাঝে ভাসিতে চায়।
ধরার পানে মেলিয়া আঁখি
উষার মতো হাসিতে চায়---
মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়,
বাতাসে হাসি গড়ায়ে যায়,
উষার হাসি ফুলের হাসি
কানন-মাঝে ছড়ায়ে যায়।
হৃদয়ে মোর আকাশে উঠে
উষার মতো ফুটিতে চায়।।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে---
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে।।
আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো---
কে ভাসালে তায়,কোথা ভেসে যায়,
কোন্ দেশে গিয়ে লাগে।
ওই মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে।।
বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি।
আমি ঘরে ফিরি,থাকি কোণে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি
কোথা কোন্ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি।
কোন্ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ'রে নাহি রাখে,ফিরে নাহি ডাকে---
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী,তারি' পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে।
রাত হয়ে আসে,শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে---
চোখ বুজে ভাবি এমন আঁধার,
কালি দিয়ে ঢালা নদীর দু-ধার---
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তীরখানি বুঝে ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি।।