কবি, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় (Sukumar Ray)- এর একটি হাসির / মজার 😃গোয়েন্দার সেরা বাংলা গল্প ডিটেকটিভ (Ḍiṭekaṭibha) ।
জলধরের মামা পুলিসের চাকরি করেন, আর তার পিসেমশাই লেখেন ডিটেকটিভ উপন্যাস। সেই জন্য জলধরের বিশ্বাস যে, চোর -ডাকাত জাল -জুয়াচোর জব্দ করবার সব রকম সংকেত সে যেমন জানে এমনটি তার মামা আর পিসেমশাই ছাড়া কেউ জানে না। কারও বাড়িতে চুরি -টুরি হলেও জলধর সকলের আগে সেখানে হাজির হয়। আর কে চুরি করল, কী চুরি হল, সে থাকলে এমন অবস্থায় কী করত, এসব বিষয়ে খুব বিজ্ঞের মতো কথা বলতে থাকে। যোগেশবাবুর বাড়িতে যখন বাসন চুরি হল,তখন জলধর তাদের বলল, " আপনারা একটুও সাবধান হতে জানেন না, চুরি তো হবেই। দেখুন তো ভাড়ার ঘরে পাশেই অন্ধকার গলি। তার উপর জানলার গরাদ নেই। একটু সেয়ানা লোক হলে এখান দিয়ে বাসন নিয়ে বানাতে কতক্ষণ ? আমাদের বাড়িতে ও-সব হবার জো নেই। আমি রামদিনকে বলে রেখেছি জানালার গায়ে এমনভাবে বাসনগুলো ঠেকিয়ে রাখবে যে জানলা খুলতে গেলেই বাসনপত্র সব ঝনঝন করে মাটিতে পড়বে। চোর জব্দ করতে হলে এসব কায়দা জানতে হয়। " সে সময়ে আমরা সকলেই জলধরের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু পরের দিন যখন শুনলাম সেই রাত্রে জলধরের বাড়িতে মস্ত চুরি হয়ে গেছে, তখন মনে হল, আগের দিন অতটা প্রশংসা করা উচিত হয়নি। জলধর কিন্তু তাতে কিছুমাত্র দামেনি। বলল, " ওই আহাম্মক রামদিনটার বোকামিতে সব মাটি হয়ে গেল। যাক আমার জিনিস চুরি করে তাকে আর হজম করতে হবে না। দিন দু-চার যেতে দাও না। "
দু -মাস গেল, চার মাস গেল, চোর কিন্তু আর ধরাই পড়ল না। চোরের উপদ্রবের কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের ইস্কুলে আবার চুরির হাঙ্গামা শুরু হল।
ছেলেরা অনেকে টিফিন নিয়ে আসে, তা থেকে খাবার চুরি যেতে লাগল।
প্রথম দিন রামপদর খবার চুরি যায়। সে বেঞ্চিের উপর খানিকটা রাবড়ি আর লুচি রেখে হাত ধুয়ে আসতে গেছে--- এর মধ্যে কে এসে লুচি -টুচি বেমালুম খেয়ে গিয়েছে। তারপর ক্রমে আরও দু-চারটি ছেলের খাবার চুরি হল। তখন আমরা জলধরকে বললাম, " কী হে ডিটেকটিভ। এই বেলা যে তোমার চোর ধরা বুদ্ধি খোলে না, তার মানেটা কী বলো দেখি ? " জলধর বলল, " আমি কি আর বুদ্ধি খাটাচ্ছি না ? সবুর করো না। " তখন সে খুব সাবধানে আমাদের কানে কানে এ কথা জানিয়ে দিল যে ইস্কুলে যে নতুন ছোকরা বেয়ারা এসেছে
তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে। কারণ, সে আসবার পর থেকে চুরি আরম্ভ হয়েছে। আমরা সবাই সেদিন থেকে তার উপর চোখ রাখতে শুরু করলাম। কিন্তু দু-দিন না যেতেই আবার চুরি। পাগলা দাশু বেচারা বাড়ি থেকে মাংসের চপ এনে টিফিনঘরের বেঞ্চির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, কে এসে তার আধখানা খেয়ে বাকিটুকু ধুলোয় ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে। পাগলা তখন রাগের চোটে চিৎকার করে গাল দিয়ে স্কুলবাড়ি মাথায় করে তুলল। আমরা সবাই বললাম, " আরে চুপচুপ, অত চেঁচাসনে। তা হলে চোর ধরা পড়বে কী করে ? " কিন্তু পাগলা কি সে কথা শোনে ?
তখন জলধর তাকে বুঝিয়ে বলল, " আর দু-দিন সবুর কর, এই নতুন ছোকরাটাকে আমি হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি---এ সমস্ত ওরই কারসাজি। "শুনে দাশু বলল, " তোমার যেমন বুদ্ধি ! ওরা হল
পশ্চিমা ব্রাম্ভণ, ওরা আবার মাংস খায় নাকি ? দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করো তো ? " সত্যিই আমাদের তো সে খেয়াল হয়নি ! ছোকরা তো কতদিন রুটি পাকিয়ে খায়, কই এক দিনও তো
ওকে মাংস খেতে দেখি না। দাশু পাগলা হোক আর যাই হোক, তার কথাটা সবাইকে মানতে হল।
জলধর কিন্তু অপ্রস্তুত হবার ছেলেই নয়। সে একগাল হেসে বলল, " আমি ইচ্ছে করে তোদের ভুল বুঝিয়েছিলাম। আরে, চোরকে না ধরা পর্যন্ত কি কিছু বলতে আছে, কোন পাকা
ডিটেকটিভ ও- রকম করে না। আমি মনে মনে যাকে চোর বলে ধরেছি সে আমিই জানি। "
তারপর কদিন আমরা খুব হুঁশিয়ারি ছিলাম; আট-দশদিন আর চুরি হয়নি। তখন জলধর বলল, " তোমরা গোলমাল করেই তোর সব মাটি করলে। চোরটা টের পেয়ে গেল যে আমি তার পেছনে লেগেছি। আর কি সে চুরি করতে সাহস পায় ? তবু ভাগ্যিস তোমাদের কাছে আসল নামটা ফাঁস করিনি। " কিন্তু সেই দিনই আবার শোনা গেল, স্বয়ং হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে থেকে তাঁর টিফিন খাবার- চুরি হয়ে গেছে। আমরা বললাম " কই হে ? চোর না তোমার ভয়ে চুরি করতে পারছিল না ? তার ভয়ে যে ঘুচে গেল দেখছি। " তারপর দু-দিন ধরে
জলধরের মুখে আর হাসি দেখা গেল না। চোরের ভাবনা ভেবে ভেবে তার পড়াশোনা এমনি ঘুলিয়ে গেল যে পণ্ডিতমশায়ের ক্লাসে সে আরেকটু হলেই মার খেত আর কি ! দু - দিন পর সে আমাদের সকলকে ডেকে একত্র করল, আর বলল, তার চোর ধরবার বন্দোবস্ত ঠিক হয়েছে। টিফিনের সময় সে একটা ঠোঙায় করে সরভাজা, লুচি আর আলুর দম রেখে চলে আসবে। তারপর কেউ যেন সেদিকে না যায়। ইস্কুলের বাইরে থেকে লুকিয়ে টিফিনের ঘরটা দেখা যায়। আমরা কয়েকজন বাড়ি যাবার ভান করে সেখানে থাকব। আর কয়েকজন থাকবে উঠোনের পশ্চিম কোণের ছোটো ঘরটাতে। সুতরাং, চোর যেদিকেই থেকেই আসুক, টিফিন ঘরে ঢুকতে গেলেই তাকে দেখা যাবে।
সেদিন টিফিনের ছুটি পর্যন্ত কারও আর পড়ায় মন বসে না। সবাই ভাবছে কতক্ষণে ছুটি হবে, আর চোর কতক্ষণে ধরা পড়বে। চোর ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কী করা যাবে, সে বিষয়েও কথাবার্তা করতে লাগল। মাস্টারমশাই বিরক্ত হয়ে ধমকাতে লাগলেন, পরেশ আর বিশ্বনাথকে বেঞ্চির উপর দাঁড়াতে হল--- কিন্তু সময়টা যেন কাটতেই চায় না। টিফিনের ছুটি হতেই জলধর তার খাবারের ঠোঙাটি টিফিনঘরে রেখে এল। জলধর, আমি আর দশ -বারোজন উঠোনের কোণের ঘরে রইলাম, আর একদল ছেলে বাইরে জিমনাস্টিকসের ঘরে লুকিয়ে থাকল। জলধর বলল, " দ্যাখ্ চোরটা যে রকম সেয়ানা দেখছি, আর যে রকম সাহস, তাকে মারধর করা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয় খুব ষন্ডা হবে। আমি বলি, সে যদি এদিকে আসে তাহলে সবাই মিলে তার গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব আর চেঁচিয়ে উঠব। তাহলে দারোয়ান- টারোয়ান সব ছুটে আসবে। আর লোকটা পালাতে গেলেও ওই কালির চিহ্ন দেখে ঠিক ধরা যাবে। " আমাদের রামপদ বলে উঠল, " কেন ? সে যে খুব ষন্ডা হবে তার মানে কি ? সে কিন্তু রাক্ষসের মতো খায় বলে তো মনে হয় না। যা চুরি করে নিয়ে নিচ্ছে সে তো কোনো দিনই খুব বেশি নয়। "জলধর বলল, " তুমিও যেমন পন্ডিত। রাক্ষসের মতো খানিকটা খেলেই বুঝি ষন্ডা বলতে হয় ?
তাহলে তো আমাদের শ্যামাদাসকেই সকলের চেয়ে ষন্ডা বলতে হয় । সেদিন ঘোষেদের নেমন্তন্নে ওরখাওয়া দেখেছিলে তো। বাবু হে, আমি যা বলেছি তার উপর ফোড়ন দিতে যেও না। আর তোমার যদি নেহাত বেশি সাহস থাকে, তুমি গিয়ে চোরের সঙ্গে লড়াই কোরো। আমরা কেউ তাতে আপত্তি করব না। আমি জানি, এ সমস্ত নেহাত যেমন- তেমন চোরের সাধ্য নয়। আমার খুব বিশ্বাস, যে লোকটা আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল --- এ সব তারই কান্ড ! "
এমন সময় হঠাৎ টিফিন ঘরের বাঁদিকে জানলাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভিতর থেকে ঠেলছে। তার পরেই সাদা মতন কী একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম, একটা মোটা হুলো-বেড়াল---- তার মুখে জলধরের সরভাজা ! তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সে এক বিঘত উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, " কেমন হে ডিটেকটিভ। ওই ষন্ডা চোরটাই তো তোমার বাড়িতে চুরি করেছিল ? তাহলে এখন ওকেই পুলিশে দিই।
ডিটেকটিভ (Ḍiṭekaṭibha) গল্প ছাড়াও কবি সুকুমার রায় (Sukumar Ray)অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিঙ্ক ক্লিক করুন ।