আমার আংটিগুলো খুলে রেখেছি,
আংটিগুলো সব খুলে রেখেছি দেরাজে;
ডানহাতের মধ্যমায় ছিল কাশ্মীরি নীলা,
অনামিকায় ছিল বার্মিজ রুবি,
কনিষ্ঠ আঙুলে সোয়াতি পান্না,
বাম হাতের মধ্যমায় ছিল সিংহলি গোমেদ,
তর্জনীতে ঝিনুকের বুক চিড়ে বের করা প্রাকৃতিক মুক্তো;
আমাকে নিরাপদ রাখতে জনৈক জ্যোতিষী সাজিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আমার দু’হাতের দশটি আঙুল!
আমি আংটিগুলো সব খুলে রেখেছি,
এখন আমার আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই,
লিংকনস্ ইন এর ডিগ্রী নেওয়ার উদ্বেগ নেই,
টেমস্ এর ব্রীজে দাঁড়িয়ে তোমাকে বুকে নেওয়ার স্বপ্ন নেই, কোনো স্বপ্ন নেই… সত্যি!
থাই-এমিরাতসে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণের, গোলার্ধের প্রান্ত সীমা স্পর্শের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই,
হিথরো বিমানবন্দরের আঠারো নম্বর গেট গলে, লন্ডন শহরের ইতিউতি রেস্টুরেন্টে বসে কারো সাথে উষ্ণ কফি পানের কোনো ইচ্ছে নেই আর, সত্যি!
আমি আংটিগুলো সব খুলে রেখেছি, সত্যি সত্যি!
আংটি পারেনি আমার রোগাক্রান্ত মায়ের মৃত্যু ঠেকাতে,
আংটি পারেনি দেশ বিভাজনের সেই দুঃসহ স্মৃতি মুছে দিতে, মুছে দিতে সেই শরণার্থী জীবনের কষ্ট,
ইরাক কিংবা সিরিয়ায় বোমারু বিমানের কর্কশ
আওয়াজ রুখে দিতে,
একের পর এক জলমগ্ন হয়েছে শস্যক্ষেত্র,
সিডরে বিলীন হয়েছে বাড়ি-ঘর, সঞ্চিত পুঁজি, বীজধান !
আমি আমার আংটিগুলো খুলে রেখেছি সত্যি,
আমার আংটি পারেনি, স্বাধীনতার সনদে দেওয়া চার নীতিতে অটল থাকতে;
আমার আংটি পারেনি, অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীর অকাল মৃত্যু রুখে দিতে;
আমার আংটি পারেনি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মুছে দিতে;
শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করতে, বিলুপ্ত করতে;
আমার আংটি পারেনি, নিজ দেহরক্ষীর উত্তপ্ত সীসায় প্রিয়দর্শীনির ভূপতন ঠেকাতে;
আমার আংটি পারেনি, জেলখানায় চার নেতাকে সশরীরে মুক্ত করতে, মৃত্যু ঠেকাতে;
আমার আংটি পারেনি, জাতির জনকের সামনে ঢাল হ’য়ে দাঁড়াতে,
বঙ্গবন্ধুর তর্জনির ভাষা বুঝিয়ে দিতে ফৌজি ঘাতকদের,
পারেনি!
আমার আংটি গুলো সব খুলে রেখেছি দু’হাতের সব কটা আঙুল থেকে,
রবি, মঙ্গল, বুধ, শনি, কেতু, রাহুর প্রভাব থেকে মুক্ত মানুষ আমি এখন;
অন্তরীন জীবন আমার, স্বেচ্ছা গৃহবন্দী, আত্মীয় স্বজন
পরিজনহীন;
আজও বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে, শোকের মাস অগাস্ট, দীর্ঘশ্বাসে ভরা, রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে অনর্গল;
দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে, যেন কত যুগ ধরে-
একাকী নিভৃতে, পালন করছি বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবস,
অশ্রু টলটলে জলের মুক্তো মালায় – অতল শ্রদ্ধায় !!