কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) মেঘনাদবধ কাব্য (৩য় সর্গ) (Meghnadbodh Kabya Third Section)।
প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী।
অশ্রুআঁখি-বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু,ব্রজ-কুঞ্জ-বনে,হায়রে, যেমনি
ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী।
অবচয়ি ফুল-চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি
কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু
ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি,
ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে,
পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে;
কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি।
চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।”
কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে
লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর-
সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে;
লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ- অরি ফিরিছে চৌদিকে
অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা”
রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;–
“কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,–
আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি?
যথা বায়ু-সখা সহ দাবানল গতি
দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে।
টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি;
ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;–
কিন্তু নিশা-কালে কবে ধূম-পুঞ্জ পারে
আবরিতে অগ্নি-শিখা? অগ্নিশিখা-তেজে
চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে।
কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে
বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি
ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ,
স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল
মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে
সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে
কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;
পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ; বন-হস্তী বনে
ডুবিল অতল জলে জলচর যত ;
শিবিরে বসেন প্রভু রঘু-চুড়ামণি
করপুটে শূর-সিংহ লক্ষণ সম্মুখে,
পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত,
রুদ্র-কুল-সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি ।
সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’-ধ্বনি
উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর কোলাহলে,
সাগর-কল্লোল যথা; ত্রস্তে রক্ষোরথী,
দাশরথি-পানে চাহি, কহিলা কেশরী,–
“চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে।
নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?”
বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে।
“ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি,
“দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া;
মায়াময় লঙ্কা-ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে;
কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি;
এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে।
শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে
আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে
এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি-কালে?
রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে;”
হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী
শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে,
(ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে;)
কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে,
আর যত গুরুজনে;— নৃ-মুন্ড-মালিনী
নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী,
বীরেন্দ্র-কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী,
তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি
সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব?
বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব
তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে? কহ শীঘ্র করি;”
উত্তরিলা ভীমা-রূপী; “বীর-শ্রেষ্ঠ তুমি,
রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে;
নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী
স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে।”
এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা,
প্রফুল্ল কুসুম যথা (শিশির মন্ডিত)
বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ-সমীরণে;
উত্তরিলা রঘুপতি; ”শুন, সুকেশিনী,
বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।
অরি মম রক্ষ-পতি; তোমরা সকলে
কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে
বৈরি-ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে?
আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”।
এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;–
“দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে,
শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা-দলে।”
প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী
হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ,
প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া,
রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক।
না জানি এ বামা-দলে কে আঁটে সমরে
ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি–
রক্তবীজ-কুল-অরি?” কহিলা রাঘব;–
”চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্র-বধূ।”
যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে,
অগ্নিময় দশ দিশ; দেখিলা সম্মুখে
রাঘবেন্দ্র বিভা-রাশি নির্ধূম আকাশে,
সুবর্নি বারিদপুঞ্জে; শুনিলা চমকি
কোদন্ড-ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া-দড়বড়ি,
হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি।
সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা,
ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী;
উড়িছে পতাকা —রত্ন-সঙ্কলিত-আভা;
মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী;
বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে।
গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে
অটল,চলিছে মধ্যে বামা-কুল-দল;
উপত্যকা-পথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ,
গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি।
সর্ব-অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী,
কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ-দন্ড করে
হৈমময়; তার পাছে চলে বাদ্যকরী,
বিদ্যাধরী-দল যথা, হায় রে ভূতলে
অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা-
আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে;
তার পাছে শূল-পাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে
প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা;
চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা
শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি;
আস্ফালিলা শূলে কেহ; হাসিলা কেহ বা
অট্টহাসে টিটকারি; কেহ বা নাদিলা,
গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী,
বীর-মদে, কাম-মদে উন্মাদ ভৈরবী;
লক্ষ্য করি রক্ষোবরে, কহিলা রাঘব;–
”কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি,
কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে;
নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?”
উত্তরিলা বিভীষণ; ”নিশার স্বপন
নহে এ,বৈদেহী-নাথ,কহিনু তোমারে।
কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে
সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী।
মহাশক্তি-সম তেজে;দম্ভোলি-নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে,
সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে
বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;”
লঙ্কার কনক-দ্বারে উতরিলা সতী
প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি
ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস,
প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা;
উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী;—
”কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে?
নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ-কুল-বধূ,
খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী
টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে;
বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী
আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে।
==========