কবি জীবনানন্দ দাশ (Jibanananda Das) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) পিরামিড (Piramid)।
বেলা বয়ে যায়
গোধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃতু্যঘন্টা বাজে!
শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে একে ডুবে যায় দেশ, জাতি,–সংসার, সমাজ,
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে-পাও নাই টের!
কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে,—চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চলে গেছে প্রিয়তম,—চলে গেছে প্রিয়া!
যুগান্ত্মের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী,
কবে কোন্ বেলাশেষে হায়
দূর অস্ত্মশেখরের গায়!
তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
সাঁজের নীহারনীল সমুদ্য মথিয়া
মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী!
তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ-সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে,—পাণ|ডুর বদনে!
—কুষ্ঞ যবনিকা করেব ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি!
জানে না তো মিশরেরর মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান!
হে নির্বাক পিরামিড,—অতীতের স্ত্মব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির!
আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির!
নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে!
জ্বলিয়া যেতেছে নত্যি নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কার!
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নিবেদিন অরুণের সনে
কোন্ আশা-দূরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
–পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দুদণ্ডের
রুধির-ফোয়ারা
কি এক প্রগল্ভ উষ্ঞ উল্লাসের সাড়া!
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন!
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্ত্মরি ফিরিয়া মনে গগনের রক্ত-পীত সাগরের পরে!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ঞিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্ত্মরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি!—
–খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার!
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে করেব কলহীন নীলার বেলায়!—
–বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে
পিরামিড হায়!
— কত আগন্তুক-কাল,—অতিথি–সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্বৃত অন্ত্মরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল!
–তুমি রহ নিরুত্তর,—নির্বেদী,—নিশ্চল!
মৌন, অন্যমনা!
—প্রিয়ার বক্ষের পরের বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক—স্বতন্হত্র স্বরাট!
—কবে সুপ্ত উত্সবের স্ত্মব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া!
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ-কৃষ্ঞ, পাণ|ডু, চূর্ণ,
ব্যথিত কপোলে!
মিশর-অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে!
বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
—ওলটিপালটি যুগ-যুগন্ত্মের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি,–,প্রেমের প্রহরা!
—মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা-ঝরা
হেমন্ত্মের বিদায়-কুহেলি,
অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দুদিনের তরে শুধু,—নবোত্ফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে!
—অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে!
(ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থ)