Kazi Nazrul Islam Poems ~ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা

বিখ্যাত দুখের কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী। কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার বিশাল তালিকা নীচে দেওয়া হল। A short biography of the famous dukher poet kazi nazrul islam. A huge list of kazi nazrul islam poems are given below.

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)
উৎস: উইকিপিডিয়া

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) ২৫ই মে, ১৮৯৯ সালে, বর্ধমান জেলার, আসানসোল মহাকুমার, চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

২৯ই আগস্ট, ১৯৭৬ সালে, ঢাকা, বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু হয় ।

কাজী নজরুল ইসলাম-এর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত সুরারোপিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গান “চল্ চল্ চল্“।

তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কবির সর্বোৎকৃষ্ট হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। এই কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। বিদ্রোহী কবিতাটি রচনায় তিনি সারা ভারতের সাহিত্য সমাজের খ্যাতি লাভ করেন।

সাহিত্য জগতে তাঁর রচিত বিখ্যাত প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম-অগ্নিবীণা। এটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা রয়েছে। কবিতা গুলির নাম ‘প্রলয়োল্লাস(কবিতা)’, ‘বিদ্রোহী’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘রক্তাম্বর- ধরণী মা’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি।

কবির লেখা একটি উল্লেখযোগ্য প্রথম পত্রোপন্যাসের নাম বাঁধন হারা

তিনি ধূমকেতু নামক একটি পত্রিকা লেখেন।এটি ১৯২২ সালে, ১২ই আগস্ট প্রকাশিত হয়।

তাঁর বিন্যস্ত আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ রয়েছে বিষের বাঁশি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির-এর অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৭৭ সালে, একুশে পদক ১৯৭৬ সালে এবং পদ্মভূষণ উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।

তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং দার্শনিক।

কবিতা

Title

কাজী নজরুল ইসলাম -এর কবিতা সমূহ (Kazi Nazrul Islam Poems)

Stobdho Rate (স্তব্ধ-রাতে) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) স্তব্ধ-রাতে (Stobdho Rate)

থেমে আসে রজনির গীত-কোলাহল,
     ওরে মোর সাথি আঁখি-জল,
          এইবার তুই নেমে আয় –
          অতন্দ্র এ নয়ন-পাতায়।
  
আকাশে শিশির ঝরে, বনে ঝরে ফুল,
রূপের পালঙ্ক বেয়ে ঝরে এলোচুল ;
কোন গ্রহে কে জড়ায়ে ধরিছে প্রিয়ায়,
উল্কার মানিক ছিঁড়ে ঝরে পড়ে যায়।
আঁখি-জল, তুই নেমে আয় –
বুক ছেড়ে নয়ন-পাতায়!…
  
          ওরে সুখবাদী
অশ্রুতে পেলিনে যারে, হাসিতে পাবি কি তারে আজি?
     আপনারে কতকাল দিবি আর ফাঁকি?
অন্তহীন শূন্যতারে কত আর রাখবি রে কুয়াশায় ঢাকি?
ভিখারি সাজিলি যদি, কেন তবে দ্বারে
এসে ফিরে যাস নিতি অন্ধকারে?
পথ হতে আন-পথে কেঁদে যাস লয়ে ভিক্ষা-ঝুলি,
প্রাসাদ যাচিস যার তারেই রহিলি শুধু ভুলি?

     সকলে জানিবে তোর ব্যথা,
শুধু সে-ই জানিবে না কাঁটা-ভরা ক্ষত তোর কোথা?
     ওরে ভীরু, ওরে অভিমানী!
যাহারে সকল দিবি, তারে তুই দিলি শুধু বাণী?
সুরের সুরায় মেতে কতটুকু কমিল রে মর্মদাহ তোর?
গানের গহিনে ডুবে কতদিন লুকাইবি এই আঁখি-লোর?
কেবলই গাঁথিলি মালা, কার তরে কেহ নাহি জানে!
  অকূলে ভাসায়ে দিস, ভেসে যায় মালা শূন্য-পানে।
  
সে-ই শুধু জানিল না, যার তরে এত মালা-গাঁথা,
জলে-ভরা আঁখি তোর, ঘুমে-ভরা আঁখি-পাতা।
কে জানে কাটিবে কিনা আজিকার অন্ধ এ নিশীথ,
হয়তো হবে না গাওয়া কাল তোর আধ-গাওয়া গীত,
হয়তো হবে না বলা, বাণীর বুদ‍্‍বুদে যাহা ফোটে নিশিদিন!
সময় ফুরায়ে যায় – ঘনায়ে আসিল সন্ধ্যা কুহেলি-মলিন!
সময় ফুরায়ে যায়, চলো এবে, বলি আঁখি তুলি –
ওগো প্রিয়, আমি যাই, এই লহো মোর ভিক্ষা-ঝুলি!
ফিরেছি সকল দ্বারে, শুধু তব ঠাঁই
ভিক্ষা-পাত্র লয়ে করে কভু আসি নাই।
  
ভরেছে ভিক্ষার ঝুলি মানিকে মণিতে,
ভরে নাই চিত্ত মোর! তাই শূন্য-চিতে
এসেছি বিবাগি আজি, ওগো রাজা-রানি,
চাহিতে আসিনি কিছু! সংকোচে অঞ্চল মুখে দিয়ো নাকো টানি।

জানাতে এসেছি শধু– অন্তর-আসনে
সব ঠাঁই ছেড়ে দিয়ে – যাহারে গোপনে
চলে গেছি বন-পথে একদা একাকী,
বুক-ভরা কথা লয়ে – জল-ভরা আঁখি।
চাহিনিকো হাত পেতে তারে কোনোদিন,
বিলায়ে দিয়েছি তারে সব, ফিরে পেতে দিইনিকো ঋণ!
  
     ওগো উদাসিনী,
তব সাথে নাহি চলে হাটে বিকিকিনি।
কারও প্রেম ঘরে টানে, কেহ অবহেলে
ভিখারি করিয়া দেয় বহুদূরে ঠেলে!
জানিতে আসিনি আমি, নিমেষের ভুলে
কখনও বসেছ কি না সেই নদী-কূলে,
     যার ভাটি-টানে –
ভেসে যায় তরি মোর দূর শূন্যপানে।
চাহি না তো কোন কিছু, তবু কেন রয়ে রয়ে ব্যাথা করে বুক,
সুখ ফিরি করে ফিরি, তবু নাহি সহা যায়
     আজি আর এ-দুঃখের সুখ।…
  
আপনারে দলিয়া, তোমারে দলিনি কোনোদিন,
আমি যাই, তোমারে আমার ব্যথা দিয়ে গেনু ঋণ।

  (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)

স্তব্ধ-রাতে (Stobdho Rate) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Naba Bharater Haldighat (নব ভারতের হলদিঘাট) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) নব ভারতের হলদিঘাট (Naba Bharater Haldighat)

বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
         নব-ভারতের হলদিঘাট,
উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে
         উঠেছিল যথা অস্তপাট।
  
আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া
         কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল,
অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে
         মধ্য গগনে কোন পাগল!
আপন বুকের রক্তঝলকে
         পাংশু রবিরে করে লোহিত,
বিমানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,
         থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত।
দেবকী মাতার বুকের পাথর
         নড়িল কারায় অকস্মাৎ
বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর
         প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।
নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ
         জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, –
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
         নব ভারতের হলদিঘাট।

অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?
         যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়,
আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার
         সৈনিকে চারি তরুণ হটায়।
ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা
         নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন,
ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –
         শনির সহিত অশনি-রণ।
দুই বাহু আর পশ্চাতে তার
         রুষিছে তিনটি বালক শের,
‘চিত্তপ্রিয়, ‘মনোরঞ্জন,
         ‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের!
বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা
         রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ!
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
         নব-ভারতের হলদিঘাট।
  
চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে
         বধিতে হয় রে চার হাজার,
মহাকাল করে কেমনে নাকাল
         নিতাই গোরার লালবাজার!
অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,
         দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ;
প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী
         করে সহস্র প্রাণ হরণ!

হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি
         আয় অহিংস-বুদ্ধগণ
হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ
         দিতে পারে তারা হেসে কেমন!
অধীন ভারত করিল প্রথম
         স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ,
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
         নব-ভারতের হলদিঘাট।
  
সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে
         অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার,
ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন
         দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়!
গগনচুম্বী গিরিশের হতে
         ইঙ্গিত দিল বীরের দল,
‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –
         তোরা যাবি যদি, এ পথে চল!
স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন
         মোদের বুকের রক্ত-ছাপ,
ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি
         মোছ রে পরাধীনতার পাপ!
তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,
         খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
         নব-ভারতের হলদিঘাট।
*********************

কাব্যগ্রন্থ – প্রলয়শিখা

নব ভারতের হলদিঘাট (Naba Bharater Haldighat) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Be Shorom (বে-শরম) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বে-শরম (Be Shorom)

আরে আরে সখী          বারবার ছি ছি
          ঠারত চঞ্চল আঁখিয়া সাঁবলিয়া।
দুরু দুরু গুরু গুরু          কাঁপত হিয়া উরু
          হাথসে গির যায় কুঙ্কুম-থালিয়া।
আর না হোরি          খেলব গোরি
          আবির ফাগ দে পানি মে ডারি
                    হা প্যারি –
          শ্যাম কী ফাগুয়া
          লাল কী লুগুয়া
ছি ছি মোরি শরম ধরম সব হারি
মারে ছাতিয়া মে কুঙ্কুম বে-শরম বানিয়া।

  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)

বে-শরম (Be Shorom) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Sneho Purush (স্নেহ-পরশ) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) স্নেহ-পরশ (Sneho Purush)

আমি      এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,
     কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম –  
     তখন মুকুরপাশে একলা গেহে
          আমারই এই সকল দেহে
     চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো!
আহা  পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম,
                              কম সরস-হরষ সম।  
     তখন তুমি নাইবা – প্রিয় – নাইবা রলে কাছে,
     জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো
     তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার আকুল কাঁপন আছে –
                              মদির অধীর পুলক নাচে!
     তখন নাইবা আমার রইল মনে
          কোনখানে মোর দেহের বনে  
     জড়িয়েছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো!
আমি  চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম –
                              ওগো শ্রাবণ-প্লাবন সম।

(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)

স্নেহ-পরশ (Sneho Purush) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Sindhu1 (সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ (Sindhu1)

হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী,
     হে অতৃপ্ত! রহি’ রহি’
      কোন্‌ বেদনায়
     উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়?
কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি?
প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভুমি!
     কথা কও, হে দুরন্ত, বল,
তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল?
     কিসের এ অশান্ত গর্জন?
     দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন
      থামিল না, বন্ধু, তব!
কোথা তব ব্যথা বাজে! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব!
     কা’রে তুমি হারালে কখন্‌?
    কোন্‌ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন?
     কে সে বালা? কোথা তার ঘর?
    কবে দেখেছিলে তারে? কেন হ’ল পর
     যারে এত বাসিয়াছ ভালো!
    কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো?
     অভিমান ক’রেছে সে?
    মানিনী ঝেপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে?
    ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে?
    চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে
    তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার?
    কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার?
      বল, বন্ধু বল,
   ও কি গান? ওকি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল-
      ও কি হুহুঙ্কার?
     ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?
     টানিয়া সে মেঘের আড়াল
    সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল?
চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ?
দূরে থাকে কলঙ্কিনী, ও কি রাগ? ও কি অনুরাগ?
     জান না কি, তাই
   তরঙ্গে আছাড়ি’ মর আক্রোশে বৃথাই?….
    মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ
    আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ!
     অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে
      এ-নিখিলে
     জানিতে না আপনারে ছাড়া।
তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া!
    বিপুল আরশি-সম ছিলে স্বচ্ছ, ছিলে স্থির,
     তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর।–

      তপস্বী! ধেয়ানী!
    তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি
     তুমি যেন উঠিলে শিহরি’।
    হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি,
      সুন্দর সুন্দর!”
    “সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর!
    সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা,
    সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা,
     সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্‌
    একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন!
    কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে
সে-কথা জানে না কেউ, জানিবে না,  চিরকাল নাহি-জানা র’বে।
এতদিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা,
    কেন যেন মনে হয়-ফাঁকা, সব ফাঁকা
    কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই,
    যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই!
    
    জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার,
    লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার,
     মাতিয়া উঠিলে তুমি!
    কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি!
    বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস,
    জাগিল অন্তত শূন্যে নীলিমা-উছাস!
    রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা,
     বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল।
    এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ,
   জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সে কি অভিনব গান!
    এ কি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল!
    এত বুক ছিল হেথা, ছিল এত কোন!
    শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা,
   হাওয়া এসে দোলা দেয়, সেও যেন ছিল জানা
      কত সে আপনা!
     জলে জলে ছলাছলি চলমান বেগে,
   ফুলে হুলে চুমোচুমি-চরাচরে বেলা ওঠে জেগে!
     আনন্দ-বিহ্বল
সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল!
বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ! স্বপ্নে চাঁদ-মুখ
হেরিয়া উঠিলে জাগি’,  ব্যথা ক’রে উঠিল ও-বুক।
কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া,
গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা!
    নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ
    দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উৎসুক উন্মুখ!
    কোন্‌ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া
   তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া!
     সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর!
     গর্জিয়া উঠিল ঘোর
      আর্ত হুহুঙ্কারে!
      বারে বারে
   বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর,
ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্ব প্রিয়া স্থির!
     ঘুচিল না অনন্ত আড়াল,
    তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদি সাথে কাল!
     কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত,
     নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত,
     নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে,
    তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে!
     সেই অশ্রু-সেই লোনা জল
তব চক্ষে — হে বিরহী বন্ধু মোরা — করে টলমল!
     এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।

চট্টগ্রাম ২৯/০৭/১৯২৬

কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল

সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ (Sindhu1) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Nil Pori (নীল পরি) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) নীল পরি (Nil Pori)

ওই    সর্ষে ফুলে লুটাল কার
            হলুদ-রাঙা উত্তরি।
            উত্তরি-বায়    গো –
ওই    আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায়
            নীল সে পরির দূর তরি॥
  
তার    অবুঝ বীণার সবুজ সুরে
            মাঠের নাটে পুলক পুরে,
ওই    গহন বনের পথটি ঘুরে
      আসছে দূরে কচিপাতা দূত ওরই॥
      মাঠঘাট তার উদাস চাওয়ায়
            হুতাশ কাঁদে গগন মগন
      বেণুর বনে কাঁপচে গো তার  
            দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন।
তার    বেতস-লতায় লুটায় তনু,  
       দিগ্‌বলয়ে ভুরুর ধনু,
সে     পাকা ধানের হীরক-রেণু
       নীল নলিনীর নীলিম-অণু
            মেখেছে মুখ বুক ভরি॥

(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

নীল পরি (Nil Pori) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Biroho Bidhura (বিরহ-বিধুরা) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বিরহ-বিধুরা (Biroho Bidhura)

কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;
সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না!
লাল-রঙিলা করব না কর মেহেদি-হেনার ছাপ ঘষে;
গুলফ চুমি কাঁদবে গো কেশ চিরুণ-চুমার আপশোশে!

কপোল-শয়ান অলক-শিশুর উদাস ঘুম আর ভাঙবে না;
চুমহারা ঠোঁট পানের পিকের হিঙুল রঙে রাঙবে না!
কার তরে ফুলশয্যা বাসর, সজ্জা নিজেই লজ্জা পায়;
পীতম আমার দূর প্রবাসে, দেখবে কে সাজ-সজ্জা হায়!

চাঁচর চুলে ধূম্র ওড়ে, অঙ্গ রাঙায় আগুন-রাগ,
যেমনি ফোটে মন-নিকষে পিয়ার ফাগুন-স্মৃতির দাগ।
সবাই বলে, চিনির চেয়েও শিরিন জীবন, – হায় কপাল!
পীতম-হারা নিম-তেতো প্রাণ কেঁদেই কাটায় সাঁঝ সকাল।

যেথায় থাকো খোশহালে রও, বন্ধু আমার – শোকের বল!
তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, – থাকুক আমার চোখের জল!

(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)

বিরহ-বিধুরা (Biroho Bidhura) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Muktibar (মুক্তি-বার) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) মুক্তি-বার (Muktibar)

লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার।
      অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
      দিনের পরে দিন গিয়েছে, হয়নি আমার ছুটি,
      বুকের ভিতর মৌন-কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি।
            আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া,
            লাগল চোখে তোমার চাওয়া,
      তাই তো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
  
তোমার তরে বুকের তলায়
            অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে
            গোপন সে সব কইব প্রিয়তমা।
  
      এবার শুধু কথায়-গানে রাত্রি হবে ভোর,
      শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর।
            তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি,
            মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
      হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি করুণ ছবি তার।

(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

মুক্তি-বার (Muktibar) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Manini (মানিনী) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) মানিনী (Manini)

মূক করে ওই মুখর মুখে লুকিয়ে রেখো না,
ওগো কুঁড়ি, ফোটার আগেই শুকিয়ে থেকো না!
নলিন নয়ান ফুলের বয়ান মলিন এদিনে
রাখতে পারে কোন সে কাফের আশেক বেদীনে?
রুচির চারু পারুল বনে কাঁদচ একা জুঁই,
বনের মনের এ বেদনা কোথায় বলো থুই?
হাসির রাশির একটি ফোঁটা অশ্রু অকরুণ,
হাজার তারা মাঝে যেন একটি কেঁদে খুন!
বেহেশতে কে আনলে এমন আবছা বেথার রেশ,
হিমের শিশির ছুঁয়ে গেছে হুরপরিদের দেশ!
বরষ পরের দরশনের কই সে হরষণ,
মিলবে না কি শিথিল তোমার বাহুর পরশন?
শরম টুটে ফুটুক কলি শিশির-পরশে
ঘোমটা ঠেলে কুণ্ঠা ফেলে সলাজ হরষে।

   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)

মানিনী (Manini) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Korthyovasha (কর্থ্যভাষা) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) কর্থ্যভাষা (Korthyovasha)

কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন।
নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥
গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী।
বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥
চাষায় আমি চশ্‌শ বলি, আশায় বলি অশ্ব।
কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥
শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম।
পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥
পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু।
বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥
চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল।
শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥
শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু।
বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥
আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু।
ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥

   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)

কর্থ্যভাষা (Korthyovasha) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।