Kazi Nazrul Islam Poems ~ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা

বিখ্যাত দুখের কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী। কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার বিশাল তালিকা নীচে দেওয়া হল। A short biography of the famous dukher poet kazi nazrul islam. A huge list of kazi nazrul islam poems are given below.

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)
উৎস: উইকিপিডিয়া

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) ২৫ই মে, ১৮৯৯ সালে, বর্ধমান জেলার, আসানসোল মহাকুমার, চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

২৯ই আগস্ট, ১৯৭৬ সালে, ঢাকা, বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু হয় ।

কাজী নজরুল ইসলাম-এর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত সুরারোপিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গান “চল্ চল্ চল্“।

তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কবির সর্বোৎকৃষ্ট হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। এই কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। বিদ্রোহী কবিতাটি রচনায় তিনি সারা ভারতের সাহিত্য সমাজের খ্যাতি লাভ করেন।

সাহিত্য জগতে তাঁর রচিত বিখ্যাত প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম-অগ্নিবীণা। এটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা রয়েছে। কবিতা গুলির নাম ‘প্রলয়োল্লাস(কবিতা)’, ‘বিদ্রোহী’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘রক্তাম্বর- ধরণী মা’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি।

কবির লেখা একটি উল্লেখযোগ্য প্রথম পত্রোপন্যাসের নাম বাঁধন হারা

তিনি ধূমকেতু নামক একটি পত্রিকা লেখেন।এটি ১৯২২ সালে, ১২ই আগস্ট প্রকাশিত হয়।

তাঁর বিন্যস্ত আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ রয়েছে বিষের বাঁশি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির-এর অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৭৭ সালে, একুশে পদক ১৯৭৬ সালে এবং পদ্মভূষণ উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।

তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং দার্শনিক।

কবিতা

Title

কাজী নজরুল ইসলাম -এর কবিতা সমূহ (Kazi Nazrul Islam Poems)

Hodolkutkuter Biggyapon (হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন (Hodolkutkuter Biggyapon)

মিচকে-মারা কয় না কথা মনটি বড়ো খুঁতখুঁতে।
‘ছিঁচকাঁদুনে’ ভ্যাবিয়ে ওঠেন একটু ছুঁতেই না ছুঁতে।
ড্যাবরা ছেলে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলান,
সন্দেশ এবং মিষ্টি খেতে – বাসরে বাস – এক জাম্বুবান!
নিম্নমুখো-যষ্টি ছেলে দশটি ছেলে লুকিয়ে খান,
বদমায়েশির মাসি পিসি, আধখানা চোখ উঁচিয়ে চান!
হাঁদারা হয় হদ্দ বোকার, সব কথাতেই হাঁ করে!
ডেঁপো চতুর আধ-ইশারায় সব বুঝে নেয় ঝাঁ করে!
ভোঁদা খোকার নামটি ভুঁদো বুদ্ধি বেজায় তার ভোঁতা।
সব চেয়ে ভাই ইবলিশ হয় যে ছেলেদের ঘাড় কোঁতা।
পুঁয়ে-লাগা সুঁটকো ছেলে মুখটা সদাই মুচকে রয়!
পেটফুলো তার মস্ত পিলে, হাত-পাগুলোও কুঁচকে রয়!
প্যাঁটরা ছেলের য়্যাব্বড়ো পেট, হাত নুলো আর পা সরু!
চলেন যেন ব্যাংটি হো হো উ-র্ গজ-ঢাক গাল পুরু!
গাবদা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশি,
আদর করে মা তারে তাই নাম দিয়েছেন মনটুসি।
ষাঁড়ের নাদ সে নাদুস নুদুস গোবর-গণেশ যে শ্রীমান,
নাঁদার মতন য়্যাভ ভুঁড়ি তাঁর চলতে গিয়ে হুমড়ি খান!
ছ্যাঁচড় ছেলে বেদড় ভারি ধুমসুনি খায় সব কথায়।
উদমো ছেলে ছটফটে খুব একটুকুতেই উতপুতায়!
ফটকে ছেলে ছটকে বেড়ায় আঁটি তারা বজ্জাতের,
দুষ্টু এবং চুলবুলেরা সবখানে পায় লজ্জা ঢের।
বোঁচা-নাকা খাঁদা যে হয় নাম রেখো তার চামচিকে,
এসব ছেলে তেঁদড় ভারী ডরায় না দাঁত-খামচিকে!
টুনিখুকির মুখটি ছোটো টুনটুনি তার মন সরল,
ময়না-মানিক নাম যার ভাই মনটি তারও খুব তরল!
গাল টেবো যাঁর নাম টেবি তাঁর একটুকুতেই যান রেগে।
কান-খড়কে মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে।
খুদে খুকির নামটি টেপু মা-দুলালি আবদেরে।
ডর-পুকুনে আঁতকে ওঠে নাপতে দেখে আঁক করে!
পুঁটুরানি বাপ-সোহাগি, নন্দদুলাল মানিক মা-র,
দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার!
ভুতো ছেলে ঠগ বড়ো হয়, ভয় করে না কাউকে সে,
নাই পরোয়া যতই কেন কিল আর থাপড় দাও ঠেসে।
দস্যি ছেলে ভয় করে না চোখ-রাঙানি ভূত-পেরেত,
সতর-চোখি জুজুর খোঁজে বেড়িয়ে বেড়ায় রাত বিরেত!
ডানপিটেরা ঝুলঝাপপুর গুলি-ডাণ্ডায় মদ্দ খুব!
বাঁদরা-মুখোর ভ্যাংচিয়ে মুখ দাঁত খিঁচে বে-হদ্দ হুব!
বীর বাদল সে – দেশের তরে প্রাণ দিতে ভাই যে শিখে,
আনবে যে সাত-সাগর-পারের বন্দিনী দেশ-লক্ষ্মীকে!
কেউ যদি ভাই হয় তোমজদের এমনিতরো মর্দ ফেরো,
হো হো! তাকে পাঠিয়ে দেব বাচ্চা হোঁদল কুতকুতের!

  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)

হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন (Hodolkutkuter Biggyapon) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Shesher Gan (শেষের গান) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) শেষের গান (Shesher Gan)

আমার   বিদায়-রথের চাকার ধ্বনি ওই গো এবার কানে আসে।
       পুবের হাওয়া তাই কেঁদে যায় ঝাউয়ের বনে দিঘল শ্বাসে।  
           ব্যথায় বিবশ গুলঞ্চ ফুল  
           মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল,  
       মাটির মায়ের কোলের মায়া ওগো আমার প্রাণ উদাসে।

       অঙ্গ আসে অলস হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে,  
       স্বপনপারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁয়া যায় নয়ন চুমে।
           হাতছানি দেয় অনাগতা,  
           আকাশ-ডোবা বিদায়-ব্যথা  
       লুটায় আমার ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন-ত্রাসে।

       মোর বেদনার কপূর্রবাস ভরপুর আজ দিগ্‌বলয়ে,  
       বনের আঁধার লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।  
           হারিয়ে পাওয়া মানসী হায়  
           নয়নজলে শয়ন তিতায়,  
       ওগো, এ কোন্ জাদুর মায়ায় দু-চোখ আমার জলে ভাসে।

আজ    আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন পায়ের আসা-যাওয়ার,
       তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার অনেক দাবি-দাওয়ার।  
           আজ কেহ নাই পথের সাথি,  
           সামনে শুধু নিবিড় রাতি,
আমায়   দূরের বাঁশি ডাক দিয়েছে, রাখবে কে আর বাঁধন-পাশে।

   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

শেষের গান (Shesher Gan) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Bibagini (বিবাগিনী) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বিবাগিনী (Bibagini)

করেছ পথের ভিখারিনি মোরে কে গো সুন্দর সন্ন্যাসী?
কোন বিবাগির মায়া-বনমাঝে বাজে ঘরছাড়া তব বাঁশি?
                  ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
তব    প্রেমরাঙা ভাঙা জোছনা
হেরো   শিশির-অশ্রু-লোচনা,
ওই    চলিয়াছে কাঁদি বরষার নদী গৈরিকরাঙা-বসনা।
ওগো    প্রেম-মহাযোগী, তব প্রেম লাগি নিখিল বিবাগি পরবাসী!
                  ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।

মম    একা ঘরে নাথ দেখেছিনু তোমা ক্ষীণ দীপালোকে হীন করি,
হেরি   বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রূপ তব মরি মরি!
      দিয়া   বেদনার পরে বেদনা
      নাথ   একী এ বিপুল চেতনা
তুমি   জাগালে আমার রোদনে, অন্ধে দেখালে বিশ্ব-দ্যোতনা।
ওগো   নিষ্ঠুর মোর! অশুভ ও-রূপ তাই এত বাজে বুকে আসি।
                  ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।

(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

বিবাগিনী (Bibagini) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Bidhura Pothikpriya (বিধুরা পথিকপ্রিয়া) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বিধুরা পথিকপ্রিয়া (Bidhura Pothikpriya)

আজ   নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো।  
      পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায় চাওয়া ছলছল?  
                          বলো সখী বলো বলো
    
      মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,  
      ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি দূরের পথিক গেছে চলে –
                          আবার ফিরে আসবে বলে গো?
      স্বর শুনে কার চমকে ওঠ? আ-হা!
      ও লো ও যে বিহগ-বেহাগ নির্ঝরিণীর কল-কল।
    
      ও নয় লো তার পায়ের ভাষা, আ-হা,
      শীতের শেষের ঝরা-পাতার বিদায় ধ্বনি ও,  
      কোন কালোরে কোন ভালোরে বাসলে ভালো, আ-হা!  
      খুঁজছ মেঘে পরদেশি কোন পলাতকার নয়ন-অমিয়?
চুমছ   কারে? ও নয় তোমার চির-চেনার চপল হাসির আলো-ছায়া,
ও যে   গুবাক-তরুর চিকন পাতায় বাদল-চাঁদের মেঘলা মায়া।
  
            ওঠো পথিক-পূজারিনি উদাসিনী বালা!
সে যে  সবুজ-দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন,  
            কে জানে ভাই, ঘরকে চলো।  
      ও কী? চোখে নামল আবার বাদল-ছায়া ঢলঢল?  
                         চলো সখি ঘরকে চলো।

(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

বিধুরা পথিকপ্রিয়া (Bidhura Pothikpriya) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Khosh Amded (খোশ আমদেদ) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) খোশ আমদেদ (Khosh Amded)

আসিলে    কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।
   ও চরণ    ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥
   দখিনের    হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি
  শবে-রাত    আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
  তালিবান    ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।
    উলসি    উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥
প্রাচীন ওই    বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু।
ভাঙা ওই    দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥
  এল কি    অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
  এল কি    আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥
  সানাইয়াঁ    ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।
  কারুণের    রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।
  খুশির এ‍    বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।
   লাল এ    লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥
বাসি ফুল    কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!
   নবীনের    আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥

পদ্মা
২৭.২.২৭
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)

খোশ আমদেদ (Khosh Amded) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Mormi (মরমি) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) মরমি (Mormi)

কোন মরমির মরম ব্যথা আমার বুকে বেদনা হানে,
          জানি গো, সেও জানেই জানে।
আমি কাঁদি তাইতে যে তার ডাগর চোখে অশ্রু আনে,
          বুঝেছি তা প্রাণের টানে।

     বাইরে বাঁধি মনকে যত
     ততই বাড়ে মর্ম-ক্ষত,
     মোর সে ক্ষত ব্যথার মতো
          বাজে গিয়ে তারও প্রাণে
          কে কয়ে যায় হিয়ার কানে।

উদাস বায়ু ধানের খেতে ঘনায় যখন সাঁঝের মায়া,
দুই জনারই নয়ন-পাতায় অমনি নামে কাজল-ছায়া!

     দুইটি হিয়াই কেমন কেমন
     বদ্ধ ভ্রমর পদ্মে যেমন,
     হায়, অসহায় মূকের বেদন
          বাজল শুধু সাঁঝের গানে,
          পুবের বায়ুর হুতাশ তানে।

(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

মরমি (Mormi) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Kornofuli (কর্ণফুলী) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) কর্ণফুলী (Kornofuli)

ওগো ও কর্ণফুলী,
উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।
যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,
আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!
তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন
আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।
যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর
ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর
বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!
কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!
তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,
দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?
– বুঝি প্রিয় সব বুঝি,
তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!

* * *

তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী –
তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?
দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,
স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?
ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,
এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?
বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,
ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,
সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?
এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?

তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,
নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ।
পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,
সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে!
নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল
বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল!
আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে
রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!

সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,
গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?
ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে
লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?
পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? –
দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?
মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? –
তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –
যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে
কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?

* * *

– ওগো চির উদাসিনী!
তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি।
তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি,
চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি।
জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে
ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে!
বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়!
যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়।
বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে!
যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!

* * *

–ওগো ও কর্ণফুলী!
তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,
‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?
আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?

যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি
কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী?
তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী?
তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি?
ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,
আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?

তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,
তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!‌
আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,
তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে!
অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়!
ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!

* * *

সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,
এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ!
ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি
যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি।
হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,
মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে!
– সে কবে বাঁচিতে চায়,
জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!

জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,
সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন!
আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়,
যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়!
হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে
বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!

বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা;
তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা!
ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,
তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা!
আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে,
ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।
হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,
বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি!
শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল,
তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!

তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি –
দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি!

   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)

কর্ণফুলী (Kornofuli) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Puber Hawa (পুবের হাওয়া) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) পুবের হাওয়া (Puber Hawa)

আমি ঝড় পশ্চিমের প্রলয়-পথিক –
অসহ যৌবন-দাহে লেলিহান-শিখ
দারুণ দাবাগ্নি-সম নৃত্য-ছায়ানটে
মাতিয়া ছুটিতেছিনু, চলার দাপটে
ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডুল করি। অগ্রে সহচরী
ঘূর্ণা-হাতছানি দিয়া চলে ঘূর্ণি-পরি
গ্রীষ্মের গজল গেয়ে পিলু-বারোয়াঁয়
উশীরের তার-বাঁধা প্রান্তর-বীণায়।
করতালি-ঠেকা দেয় মত্ত তালিবন
কাহারবা-দ্রুততালে। – আমি উচাটন
মন্মথ-উম্মদ আঁখি রাগরক্ত ঘোর
ঘূর্ণিয়া পশ্চাতে ছুটি, প্রমত্ত চকোর
প্রথম-কামনা-ভিতু চকোরিণী পানে
ধায় যেন দুরন্ত বাসনা-বেগ-টানে।
সহসা শুনিনু কার বিদায়-মন্থর
শ্রান্ত শ্লথ গতি-ব্যথা, পাতা-থরথর
পথিক-পদাঙ্ক-আঁকা পুব-পথশেষে।
দিগন্তের পর্দা ঠেলি হিমমরুদেশে
মাগিছে বিদায় মোর প্রিয়া ঘূর্ণি-পরি,
দিগন্ত ঝাপসা তার অশ্রুহিমে ভরি।
গোলে-বকৌলির দেশে মেরু-পরিস্থানে
মিশে গেল হাওয়া-পরি।
      অযথা সন্ধানে
দিকচক্ররেখা ধরি কেঁদে কেঁদে চলি
শ্রান্ত অশ্বশ্বসা-গতি। চম্পা-একাবলী
ছিন্ন ম্লান ছেয়ে আছে দিগন্ত ব্যাপিয়া, –
সেই চম্পা চোখে চাপি ডাকি, ‘পিয়া পিয়া’!
বিদায়-দিগন্ত ছানি নীল হলাহল
আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল –
সাগরে ডুবিল মোর আলোক-কমলা,
আঁখি মোর ঢুলে আসে – শেষ হল চলা!
জাগিলাম জন্মান্তর-জাগরণ-পারে
যেন কোন্ দাহ-অন্ত ছায়া-পারাবারে
বিচ্ছেদ-বিশীর্ণ তনু, শীতল-শিহর!
প্রতি রোমকূপে মোর কাঁপে থরথর।
  
কাজল-সুস্নিগ্ধ কার অঙ্গুলি-পরশ
বুলায় নয়ন মোর, দুলায়ে অবশ
ভার-শ্লথ তনু মোর ডাকে – ‘জাগো পিয়া।
জাগো রে সুন্দর মোরি রাজা শাঁবলিয়া।’

জল-নীলা ইন্দ্রনীলকান্তমণি-শ্যামা
এ কোন মোহিনী তন্বী জাদুকরী বামা
জাগাল উদয়-দেশে নব মন্ত্র দিয়া
ভয়াল-আমারে ডাকি – ‘হে সুন্দর পিয়া!’
– আমি ঝড় বিশ্ব-ত্রাস মহামৃত্যুক্ষুধা,
ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা – ওগো এত সুধা,
কোথা ছিল অগ্নিকুণ্ড মোর দাবদাহে?
এত প্রেমতৃষা সাধ গরল প্রবাহে? –
  
আবার ডাকিল শ্যামা, ‘জাগো মোরি পিয়া!’
এতক্ষণ আপনার পানে নিরখিয়া
হেরিলাম আমি ঝড় অনন্ত সুন্দর
পুরুষ-কেশরী বীর! প্রলয়কেশর
স্কন্ধে মোর পৌরুষের প্রকাশে মহিমা!
চোখে মোর ভাস্বরের দীপ্তি-অরুণিমা
ঠিকরে প্রদীপ্ত তেজে! মুক্ত ঝোড়ো কেশে
বিশ্বলক্ষ্মী মালা তার বেঁধে দেন হেসে!
  
এ কথা হয়নি মনে আগে, – আমি বীর
পরুষ পুরুষ-সিংহ, জয়লক্ষ্মী-শ্রীর
স্নেহের দুলাল আমি; আমারেও নারী
ভালোবাসে, ভালোবাসে রক্ত-তরবারি
ফুল-মালা চেয়ে! চাহে তারা নর
অটল-পৌরুষ বীর্যবন্ত শক্তিধর!
জানিনু যেদিন আমি এ সত্য মহান –
হাসিল সেদিন মোর মুখে ভগবান
মদনমোহন-রূপে! সেই সে প্রথম
হেরিনু, সুন্দর আমি সৃষ্টি-অনুপম!
  
যাহা কিছু ছিল মোর মাঝে অসুন্দর
অশিব ভয়াল মিথ্যা অকল্যাণকর
আত্ম-অভিমান হিংসা দ্বেষ-তিক্ত ক্ষোভ –
নিমেষে লুকাল কোথা, স্নিগ্ধশ্যাম ছোপ
সুন্দরের নয়নের মণি লাগি মোর প্রাণে!
পুবের পরিরে নিয়া অস্তদেশ পানে
এইবার দিনু পাড়ি। নটনটী-রূপে
গ্রীষ্মদগ্ধ তাপশুষ্ক মারী-ধ্বংস-স্তূপে
নেচে নেচে গাই নবমন্ত্র সামগান
শ্যামল জীবনগাথা জাগরণতান!
  
এইবার গাহি নেচে নেচে,
রে জীবন-হারা, ওঠ বেঁচে!
রুদ্র কালের বহ্নি-রোষ
নিদাঘের দাহ গ্রীষ্ম-শোষ
নিবাতে এনেছি শান্তি-সোম,
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
  
জেগে ওঠ ওরে মূর্ছাতুর!
হোক অশিব মৃত্যু দূর!
গাহে উদ্‌গাতা সজল ব্যোম,
ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি,  শান্তি ওম॥

এসো মোর   শ্যাম-সরসা
ঘনিমার      হিঙুল-শোষা
বরষা        প্রেম-হরষা
  প্রিয়া মোর   নিকষ-নীলা
শ্রাবণের      কাজল গুলি
ওলো আয়    রাঙিয়ে তুলি
সবুজের       জীবন-তুলি,
  মৃতে কর   প্রাণ-রঙিলা॥
আমি ভাই     পুবের হাওয়া
বাঁচনের       নাচন-পাওয়া,
কারফায়      কাজরি গাওয়া,
  নটিনীর   পা-ঝিনঝিন!
নাচি আর     নাচনা শেখাই
পুরবের       বাইজিকে ভাই,
ঘুমুরের       তাল দিয়ে যাই –
  এক দুই     এক দুই তিন॥
  
বিল ঝিল     তড়াগ পুকুর
পিয়ে নীর     নীল কম্বুর
থইথই        টইটম্বুর!
ধরা আজ     পুষ্পবতী!
শুশুনির       নিদ্রা শুষি
রূপসি       ঘুম-উপোসি!
কদমের      উদমো খুশি
দেখায় আজ   শ্যাম যুবতি॥
হুরিরা       দূর আকাশে
বরুণের      গোলাব-পাশে
ধারা-জল     ছিটিয়ে হাসে
  বিজুলির     ঝিলিমিলিতে!
অরুণ আর     বরুণ রণে
মাতিল        ঘোর স্বননে
আলো-ছায়     গগন-বনে
  ‘শার্দূল বিক্রীড়িতে।’

(শার্দূল-বিক্রীড়িত ছন্দে)
  
উত্রাস ভীম
    মেঘে কুচকাওয়াজ
      চলিছে আজ,
সোন্মাদ সাগর
    খায় রে দোল!
ইন্দ্রের রথ
    বজ্রের কামান
    টানে উজান
    মেঘ-ঐরাবত
    মদ-বিভোল।
  
যুদ্ধের রোল
     বরুণের জাঁতায়
    নিনাদে ঘোর,
     বারীশ আর বাসব
            বন্ধু আজ।
  
সূর্যের তেজ
    দহে মেঘ-গরুড়
      ধূম্র-চূড়,
    রশ্মির ফলক
      বিঁধিছে বাজ।
  
বিশ্রাম-হীন
    যুঝে তেজ-তপন
      দিক-বারণ
    শির-মদ-ধারায়
      ধরা মগন!
  
অম্বর-মাঝ
    চলে আলো-ছায়ায়
      নীরব রণ
    শার্দূল শিকার
    খেলে যেমন।
  
রৌদ্রের শর
    খরতর প্রখর
       ক্লান্ত শেষ,
    দিবা দ্বিপ্রহর
       নিশি-কাজল!
সোল্লাস ঘোর
    ঘোষে বিজয়-বাজ
       গরজি আজ
    দোলে সিং-বি-
       ক্রীড়ে দোল।

(সিংহ-বিক্রীড় ছন্দে)
  
নাচায় প্রাণ     রণোন্মাদ-     বিজয়-গান,     গগনময়     মহোৎসব।
রবির পথ      অরুণ-যান     কিরণ-পথ      ডুবায় মেঘ-  মহার্ণব।
  
মেঘের ছায়    শীতল কায়     ঘুমায় থির       দিঘির জল   অথই থই।
তৃষায় ক্ষীণ    ‘ফটিক জল’   ‘ফটিক জল’    কাঁদায় দিল   চাতক ওই।
  
মাঠের পর     সোহাগ-ঢল     জলদ-দ্রব       ছলাৎছল    ছলাৎছল
পাহাড়-গায়     ঘুমায় ঘোর     অসিত মেঘ-     শিশুর দল   অচঞ্চল।
  
বিলোল-চোখ   হরিণ চায়       মেঘের গায়,     চমক খায়   গগন-কোল,
নদীর-পার    চখির ডাক       ‘কোয়াককো’     বনের বায়   খাওয়ায় টোল।
  
স্বয়ম্ভূর       সতীর শোক-      ধ্যানোম্মাদ-      নিদাঘ-দাব   তপের কাল
নিশেষ আজ!  মহেশ্বর          উমার গাল       চুমার ঘায়    রাঙায় লাল।

(অনঙ্গশেখর ছন্দে)
  
এবার আমার     বিলাস শুরু     অনঙ্গশেখরে।
পরশ-সুখে       শ্যামার বুকে     কদম্ব শিহরে।
কুসুমেষুর        পরশ-কাতর     নিতম্ব-মন্থরা
সিনান-শুচি      স-যৌবনা       রোমাঞ্চিত ধরা।
ঘন শ্রোণির,     গুরু ঊরুর,      দাড়িম-ফাটার ক্ষুধা
যাচে গো আজ   পরুষ-পীড়ন      পুরুষ-পরশ-সুধা।
শিথিল-নীবি      বিধুর বালা      শয়ন-ঘরে কাঁপে,
মদন-শেখর      কুসুম-স্তবক      উপাধানে চাপে।
  
আমার বুকের     কামনা আজ     কাঁদে নিখিল জুড়ি,
বনের হিয়ায়      তিয়াস জিয়ায়    প্রথম কদম-কুঁড়ি।
শাখীরা আজ     শাখায় শাখা      পাখায় পাখায় বাঁধা,
কুলায় রচে,      মনে শোনে       শাবক শিশুর কাঁদা।
  
তাপস-কঠিন      উমার গালে      চুমার পিয়াস জাগে,
বধূর বুকে        মধুর আশা      কোলে কুমার মাগে!
তরুণ চাহে       করুণ চোখে      উদাসী তার আঁখি,
শোনে, কোথায়   কাঁদে ডাহুক      ডাহুকের ডাকি!
  
এবার আমার     পথের শুরু       তেপান্তরের পথে,
দেখি হঠাৎ       চরণ রাঙা       মৃণাল-কাঁটার ক্ষতে।
ওগো আমার      এখনও যে      সকল পথই বাকি,
মৃণাল হেরি       মনে পড়ে        কাহার কমল-আঁখি!

    (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

পুবের হাওয়া (Puber Hawa) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Pronoy Nibedon (প্রণয় নিবেদন) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) প্রণয় নিবেদন (Pronoy Nibedon)

লো কিশোরী কুমারী!
         পিয়াসি মন তোমার ঠোঁটের একটি গোপন চুমারই॥
                           অফুট তোমার অধর ফুলে
                           কাঁপন যখন নাচন তুলে
                  একটু চাওয়ায় একটু ছুঁলে গো!
তখন      এ-মন যেমন কেমন-কেমন কোন্ তিয়াসে কোঙারি? –
  ওই     শরম-নরম গরম ঠোঁটের অধীর মদির ছোঁয়ারই।
  
         বুকের আঁচল মুখের আঁচল বসন-শাসন টুটে
ওই       শঙ্কা-আকুল কী কী আশা ভালোবাসা ফুটে সই?
                           নয়ন-পাতার শয়ন-ঘেঁসা
                           ফুটচে যে ওই রঙিন নেশা
                           ভাসা-ভাসা বেদনমেশা গো!
  ওই     বেদন-বুকে যে সুখ চোঁয়ায় ভাগ দিয়ো তার কোঙারই!
আমার     কুমার হিয়া মুক্তি মাগে অধর ছোঁয়ায় তোমারই॥
  

    (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)

প্রণয় নিবেদন (Pronoy Nibedon) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Sindhu3 (সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ) ~ কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)

কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ (Sindhu3)

হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি,
এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি!
এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,
  বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরলি না প্রাণ?
  দুরন্ত গো, মহাবাহু
   ওগো রাহু,
তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী!
সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী!

হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার।
সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার।
শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি
   করিছে বন্দনা তব, বলী!
তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল
   আপনাতে আপনি বিভোল!
পাশে না শ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত;
দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত,
দেখিবে সুদূরে ভবিষ্যৎ-
মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ!
ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মতো
জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত!

হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান
সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান!
জগতের যত পাপ গ্লানি
হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি!
ধরা তব আদরিনী মেয়ে,
তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে!
হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার,
কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভরা!
জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক,
  ভাঙ’ গড়’ দোলা দাও,-
কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক!
হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়,
নিত্য নব নব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়!

হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া
ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া
ইন্দ্রানীলকান্তমণি মেখলার সম,
মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম!
বন্ধু, তব অনন্ত যৌবন
তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন!
কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে,
কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে,
চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন!
কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন!

মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর
মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর,
হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া
তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া!
ক’রেছে লুন্ঠন
তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন!
সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল,
আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল
উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার,
মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার!

হে মহান! হে চির-বিরহী!
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোর বিদ্রোহী,
সুন্দর আমার!
   নমস্কার!
   নমস্কার লহ!
তুমি কাঁদ,-আমি কাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ।
হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল,
এ অনন্ত বিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল।
মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর,
তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার!
বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়
উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া!
তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার,
মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।

চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬

কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল

সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ (Sindhu3) কবিতাটি ছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) -এর অন্যান্য কবিতা পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।