Michael Madhusudan Dutt Poems~ মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা

Shurjo O Moinak Giri (সূর্য্য ও মৈনাক-গিরি) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) সূর্য্য ও মৈনাক-গিরি (Shurjo O Moinak Giri)

উদয়-অচলে,
দিবা-মুখে এক-চক্রে দিলা দরশন,
       অংশু-মালা গলে,
বিতরি সুবর্ণ-রশ্মি চৌদিকে তপন।
       ফুটিল কমল-জলে
       সূর্য্যমুখী সুখে স্থলে,
       কোকিল গাইল কলে,
       আমোদি কানন।
জাগে বিশ্বে নিদ্রা ত্যজি বিশ্ববাসী জন;
পুনঃ যেন দেব স্রষ্টা সৃজিলা মহীরে;
সজীব হইলা সবে জনমি, অচিরে।
      অবহেলি উদয়-অচলে,
      শূন্য-পথে রথবর চলে;
      বাড়িতে লাগিল বেলা,
      পদ্মের বাড়িল খেলা,
রজনী তারার মেলা সর্ব্বত্র ভাঙ্গিল;—
কর-জালে দশ দিক্ হাসি উজলিল।
উঠিতে লাগিলা ভানু নীল নভঃস্থলে;
দ্বিতীয়-তপন-রূপে নীল সিন্ধু-জলে
       মৈনাক ভাসিল।
কহিল গম্ভীরে শৈল দেব দিবাকরে;—
“দেখি তব ধীর গতি দুখে আঁখি ঝরে;
পাও যদি কষ্ট,—এস, পৃষ্ঠাসন দিব;
যেখানে উঠিতে চাও, সবলে তুলিব।”
কহিলা হাসিয়া ভানু;—“তুমি শিষ্টমতি;
দৈববলে বলী অামি, দৈববলে গতি।”

      মধ্যাকাশে শোভিল তপন,—
      উজ্জ্বল-যৌবন, প্রচণ্ড-কিরণ;
তাপিল উত্তাপে মহী; পবন বহিলা
অাগুনের শ্বাস-রূপে; সব শুকাইলা—
      শুকাল কাননে ফুল;
      প্রাণিকুল ভয়াকুল;
জলের শীতল দেহ দহিয়া উঠিল;
     কমলিনী কেবল হাসিল!
     হেন কালে পতনের দশা,
     আ মরি; সহসা
     আসি উতরিল;—
হিরণ্ময় রাজাসন ত্যজিতে হইল!
      অধোগামী এবে রবি,
      বিষাদে মলিন-ছবি,
হেরি মৈনাকেরে পুনঃ নীল সিন্ধু-জলে,
      সম্ভাষি কহিলা কুতূহলে;—
“পাইতেছি কষ্ট, ভাই, পূর্ব্বাসন লাগি;
দেহ পৃষ্ঠাসন এবে, এই বর মাগি;
লও ফিরে মোরে, সখে, ও মধ্য-গগনে;—
অাবার রাজত্ব করি, এই ইচ্ছা মনে।”
হাসি উত্তরিল শৈল;—“হে মূঢ় তপন,
অধঃপাতে গতি যার কে তার রক্ষণ!
রমার থাকিলে কৃপা, সবে ভালবাসে;—
কাঁদ যদি, সঙ্গে কাঁদে; হাস যদি, হাসে;
ঢাকেন বদন যবে মাধব-রমণী,
সকলে পলায় রড়ে, দেখি যেন ফণী।”

সূর্য্য ও মৈনাক-গিরি (Shurjo O Moinak Giri) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Bhut Kal (ভূত কাল) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) ভূত কাল (Bhut Kal)

কোন্ মূল্য দিয়া পুনঃ কিনি ভূত কালে,
—-কোন্ মূল্য —-এ মন্ত্রণা কারে লয়ে করি?
কোন্ ধন, কোন্ মুদ্রা, কোন্ মণি-জালে
এ দুর্ল্লভ দ্রব্য-লাভ ? কোন্ দেবে স্মরি,
কোন্ যোগে,কোন্ তপে,কোন্ ধর্ম্ম করি?
আছে কি এমন জন ব্রাহ্মণে,চণ্ডালে,
এ দীক্ষা-শিক্ষার্থে যারে গুরু-পদে বরি,
এ তত্ত্ব-স্বরূপ পদ্ম পাই যে মৃণালে?—
পশে যে প্রবাহ বহি অকূল সাগরে,
ফিরি কি সে আসে পুনঃ পর্ব্বত-সদনে?
যে বারির ধারা ধরা সতৃষ্ণায় ধরে,
উঠে কি সে পুনঃ কভু বারিদাতা ঘনে?—
বর্ত্তমানে তোরে,কাল,যে জন আদরে
তার তুই!গেলে তোরে পায় কোন্ জনে?

ভূত কাল (Bhut Kal) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Tara (তারা) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) তারা (Tara)

নিত্য তোমা হেরি প্রাতে ওই গিরি-শিরে
কি হেতু, কহ তা মোরে, সুচারু-হাসিনি ?
নিত্য অবগাহি দেহ শিশিরের নীরে,
দেও দেখা, হৈমবতি, থাকিতে যামিনী।
বহে কলকল রবে স্বচ্ছ প্রবাহিণী
গিরি-তলে ; সে দর্পণে নিরখিতে ধীরে
ও মুখের আভা কি লো, আইস, কামিনি,
কুসুম-শয়ন থুয়ে সুবর্ণ মন্দিরে?—
কিম্বা, দেহ কারাগার তেয়াগি ভূতলে,
স্নেহ-কারী জন-প্রাণ তুমি দেব-পুরে,
ভাল বাসি এ দাসেরে, আইস এ ছলে
হৃদয় আঁধার তার খেদাইতে দূরে ?
সত্য যদি, নিত্য তবে শোভ নভস্তলে,
জুড়াও এ আঁখি দুটি নিত্য নিত্য ঊরে।।

তারা (Tara) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Valmiki (বাল্মীকি) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বাল্মীকি (Valmiki)

স্বপনে ভ্রমিনু আমি গহন কাননে
একাকী ৷ দেখিনু দূরে যুব এক জন,
দাঁড়ায়ে তাহার কাছে প্রাচীন ব্রাহ্মণ—
দ্রোণ যেন ভয়-শূন্য কুরুক্ষেত্র-রণে ৷
''চাহিস্ বধিতে মোরে কিসের কারণে?''
জিজ্ঞাসিলা দ্বিজবর মধুর বচনে ৷
''বধি তোমা হরি আমি লব তব ধন,''
উত্তরিলা যুব জন ভীম গরজনে ৷—
পরিবরতিল স্বপ্ন ৷ শুনিনু সত্বরে
সুধাময় গীত-ধ্বনি,আপনি ভারতী,
মোহিতে ব্রহ্মার মনঃ,স্বর্ণ বীণা করে,
আরম্ভিলা গীত যেন—মনোহর অতি!
সে দুরন্ত যুব জন,সে বৃদ্ধের বরে,
হইল,ভারত,তব কবি-কুল-পতি!

বাল্মীকি (Valmiki) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Pururoba (পুরুরবা) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) পুরুরবা (Pururoba)

যথা ঘোর বনে ব্যাধ বধি অজাগরে,
চিরি শিরঃ তার, লভে অমূল রতনে ;
বিমুখি কেশীরে আজি, হে রাজা, সমরে,
লভিলা ভুবন-লোভ তুমি কাম-ধনে !
হে সুভগ, যাত্রা তব বড় শুভ ক্ষণে !—
ঐ যে দেখিছ এবে, গিরির উপরে,
আচ্ছন্ন, হে মহীপতি, মূৰ্চ্ছা-রূপ ঘনে
চাঁদেরে, কে ও, তা জান ? জিজ্ঞাস সত্বরে,
পরিচয় দেবে সখী, সমুখে যে বসি ।
মানসে কমল, বলি, দেখেছ নয়নে ;
দেখেছ পূর্ণিমা-রাত্রে শরদের শশী ;
বধিয়াছ দীর্ঘ-শৃঙ্গী কুরঙ্গে কাননে;—
সে সকলে ধিক্ মান ! ওই হে উৰ্ব্বশী !
সোণার পুতলি যেন, পড়ি অচেতনে।

পুরুরবা (Pururoba) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Ishwarchandra Gupta (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (Ishwarchandra Gupta)

স্রোতঃ-পথে বহি যথা ভীষণ ঘোষণে
ক্ষণ কাল, অল্পায়ুঃ পয়োরাশি চলে
বরিষায় জলাশয়ে ; দৈব-বিড়ম্বনে
ঘটিল কি সেই দশা সুবঙ্গ-মণ্ডলে
তোমার, কোবিদ বৈদ্য ? এই ভাবি মনে,—
নাহি কি হে কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে ?
আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য-ব্রজধামে
জীবে তুমি ; নানা খেলা খেলিলা হরষে ;
যমুনা হয়েছ পার ; তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা ? স্মরণ-নিকষে,
মন্দ-স্বর্ণ-রেখা-সম এবে তব নামে
নাহি কি হে জ্যোতিঃ, ভাল স্বর্ণের পরশে?

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (Ishwarchandra Gupta) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Kak O Shrigali (কাক ও শৃগালী) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) কাক ও শৃগালী (Kak O Shrigali)

একটি সন্দেশ চুরি করি,
উড়িয়া বসিলা বৃক্ষোপরি,
              কাক, হৃষ্ট-মনে;
    সুখাদ্যের বাস পেয়ে,
    আইল শৃগালী ধেয়ে,
দেখি কাকে কহে দুষ্টা মধুর বচনে;—
   “অপরূপ রূপ তব, মরি!
    তুমি কি গো ব্রজের শ্রীহরি,—
গোপিনীর মনোবাঞ্ছা?—কহ গুণমণি!

     হে নব নীরদ-কান্তি,
     ঘুচাও দাসীর ভ্রান্তি,
যুড়াও এ কান দুটি করি বেণু-ধ্বনি!
     পুণ্যবতী গোপ-বধূ অতি।
     তেঁই তারে দিলা বিধি,
     তব সম রূপ-নিধি,—
মোহ হে মদনে তুমি; কি ছার যুবতী?
গাও গীত, গাও, সখে করি এ মিনতি!
    কুড়াইয়া কুসুম-রতনে,
    গাঁথি মালা সুচারু গাঁথনে,

কাক ও শৃগালী (Kak O Shrigali) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Meghnadbodh Kabya Third Sorgho (মেঘনাদবধ কাব্য (তৃতীয় সর্গ)) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) মেঘনাদবধ কাব্য (তৃতীয় সর্গ) (Meghnadbodh Kabya Third Sorgho)

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী।
অশ্রুআঁখি-বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু,ব্রজ-কুঞ্জ-বনে,হায়রে, যেমনি
ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী।
অবচয়ি ফুল-চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি
কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু
ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি,
ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে,
পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে;
কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি।
চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।”
কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে
লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর-
সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে;
লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ- অরি ফিরিছে চৌদিকে
অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা”
রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;–
“কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,–
আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি?
যথা বায়ু-সখা সহ দাবানল গতি
দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে।
টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি;
ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;–
কিন্তু নিশা-কালে কবে ধূম-পুঞ্জ পারে
আবরিতে অগ্নি-শিখা? অগ্নিশিখা-তেজে
চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে।
কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে
বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি
ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ,
স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল
মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে
সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে
কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;
পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ; বন-হস্তী বনে
ডুবিল অতল জলে জলচর যত ;
শিবিরে বসেন প্রভু রঘু-চুড়ামণি
করপুটে শূর-সিংহ লক্ষণ সম্মুখে,
পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত,
রুদ্র-কুল-সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি ।
সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’-ধ্বনি
উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর কোলাহলে,
সাগর-কল্লোল যথা; ত্রস্তে রক্ষোরথী,
দাশরথি-পানে চাহি, কহিলা কেশরী,–
“চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে।
নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?”
বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে।
“ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি,
“দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া;
মায়াময় লঙ্কা-ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে;
কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি;
এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে।
শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে
আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে
এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি-কালে?
রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে;”
হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী
শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে,
(ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে;)
কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে,
আর যত গুরুজনে;— নৃ-মুন্ড-মালিনী
নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী,
বীরেন্দ্র-কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী,
তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি
সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব?
বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব
তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে? কহ শীঘ্র করি;”
উত্তরিলা ভীমা-রূপী; “বীর-শ্রেষ্ঠ তুমি,
রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে;
নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী
স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে।”
এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা,
প্রফুল্ল কুসুম যথা (শিশির মন্ডিত)
বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ-সমীরণে;
উত্তরিলা রঘুপতি; ”শুন, সুকেশিনী,
বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।
অরি মম রক্ষ-পতি; তোমরা সকলে
কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে
বৈরি-ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে?
আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”।
এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;–
“দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে,
শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা-দলে।”
প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী
হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ,
প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া,
রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক।
না জানি এ বামা-দলে কে আঁটে সমরে
ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি–
রক্তবীজ-কুল-অরি?” কহিলা রাঘব;–
”চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্র-বধূ।”
যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে,
অগ্নিময় দশ দিশ; দেখিলা সম্মুখে
রাঘবেন্দ্র বিভা-রাশি নির্ধূম আকাশে,
সুবর্নি বারিদপুঞ্জে; শুনিলা চমকি
কোদন্ড-ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া-দড়বড়ি,
হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি।
সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা,
ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী;
উড়িছে পতাকা —রত্ন-সঙ্কলিত-আভা;
মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী;
বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে।
গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে
অটল,চলিছে মধ্যে বামা-কুল-দল;
উপত্যকা-পথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ,
গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি।
সর্ব-অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী,
কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ-দন্ড করে
হৈমময়; তার পাছে চলে বাদ্যকরী,
বিদ্যাধরী-দল যথা, হায় রে ভূতলে
অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা-
আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে;
তার পাছে শূল-পাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে
প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা;
চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা
শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি;
আস্ফালিলা শূলে কেহ; হাসিলা কেহ বা
অট্টহাসে টিটকারি; কেহ বা নাদিলা,
গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী,
বীর-মদে, কাম-মদে উন্মাদ ভৈরবী;
লক্ষ্য করি রক্ষোবরে, কহিলা রাঘব;–
”কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি,
কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে;
নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?”
উত্তরিলা বিভীষণ; ”নিশার স্বপন
নহে এ,বৈদেহী-নাথ,কহিনু তোমারে।
কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে
সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী।
মহাশক্তি-সম তেজে;দম্ভোলি-নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে,
সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে
বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;”
লঙ্কার কনক-দ্বারে উতরিলা সতী
প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি
ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস,
প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা;
উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী;—
”কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে?
নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ-কুল-বধূ,
খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী
টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে;
বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী
আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে।

==========

মেঘনাদবধ কাব্য (তৃতীয় সর্গ) (Meghnadbodh Kabya Third Sorgho) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Bosonte 2 (বসন্তে-২) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বসন্তে-২ (Bosonte 2)

(১)

     সখি রে,—
বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে!
পিককুল কলকল,          চঞ্চল অলিদল,
                    উছলে সুরবে জল,
                       চল লো বনে!
চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি ব্ৰজরমণে!

(২)

     সখি রে,—
উদয় অচলে ঊষা, দেখ, আসি হাসিছে!
এ বিরহ বিভাবরী           কাটানু ধৈরজ ধরি
                    এবে লো রব কি করি?
                       প্রাণ কাঁদিছে!
চল লো নিকুঞ্জে যথা কুঞ্জমণি নাচিছে!

(৩)

     সখি রে,—
পূজে ঋতুরাজে আজি ফুলজালে ধরণী!
ধূপরূপে পরিমল,           আমোদিছে বনস্থল,
                    বিহঙ্গমকুলকল,
                       মঙ্গল ধ্বনি!
চল লো, নিকুঞ্জ পূজি শ্যামরাজে, স্বজনি!

(৪)

     সখি রে,—
পাদ্যরূপে অশ্রুধারা দিয়া ধোব চরণে!
দুই কর কোকনদে,          পূজিব রাজীব পদে;
                    শ্বাসে ধূপ, লো প্রমদে,
                       ভাবিয়া মনে!
কঙ্কণ কিঙ্কিণী ধ্বনি বাজিবে লো সঘনে।

(৫)

     সখি রে,—
এ যৌবন ধন, দিব উপহার রমণে!
ভালে যে সিন্দূরবিন্দু,          হইবে চন্দনবিন্দু;—
                    দেখিব লো দশ ইন্দু
                       সুনখগণে!
চিরপ্রেম বর মাগি লব, ওলো ললনে!

(৬)

     সখি রে,—
বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে!
পিককুল কলকল,          চঞ্চল অলিদল
                    উছলে সুরবে জল,
                       চল লো বনে!
চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি—মধুসূদনে!

(ব্রজাঙ্গনা কাব্য)

বসন্তে-২ (Bosonte 2) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।

Bngshi Dhwoni (বংশী-ধ্বনি) ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা (Bangla Kobita) বংশী-ধ্বনি (Bngshi Dhwoni)

নাচিছে কদম্বমূলে,
         বাজায়ে মুরলী,রে,
     রাধিকারমণ!
চল,সখি,ত্বরা করি,
            দেখিগে প্রাণের হরি,
       ব্রজের রতন!
চাতকী আমি স্বজনি,
               শুনি জলধর-ধ্বনি
কেমনে ধৈরজ ধরি থাকি লো এখন?
         যাক্ মান,যাক্ কুল,
                  মন-তরী পাবে কূল;
চল,ভাসি প্রেমনীরে,ভেবে ও চরণ!

       মানস সরসে,সখি,
                     ভাসিছে মরাল রে,
              কমল কাননে!
      কমলিনী কোন্ ছলে,
                      থাকিবে ডুবিয়া জলে,
             বঞ্চিয়া রমণে?
        যে যাহারে ভাল বাসে,
                         যে যাইবে তার পাশে—
     মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিব কেমনে?
             যদি অবহেলা করি,
                       রুষিবে শম্বর-অরি;
     কে সম্বরে স্মর-শরে এ তিন ভুবনে!

ওই শুন,পুনঃ বাজে
                 মজাইয়া মন,রে,
            মুরারির বাঁশী!
সুমন্দ মলয় আনে
            ও নিনাদ মোর কাণে—
       আমি শ্যাম-দাসী।
জলদ গরজে যবে,
               ময়ূরী নাচে সে রবে;—
আমি কেন না কাটিব শরমের ফাঁসি?
         সৌদামিনী ঘন সনে,
                   ভ্রমে সদানন্দ মনে;—
রাধিকা কেন ত্যজিবে রাধিকাবিলাসী।

ফুটিছে কুসুমকুল
                 মুঞ্জু কুঞ্জবনে,রে,
        যথা গুণমণি!
হেরি মোর শ্যামচাঁদ,
                  পীরিতের ফুল ফাঁদ,
             পাতে লো ধরণী!
      কি লজ্জা!হা ধিক্ তারে,
                   ছয় ঋতু বরে যারে,
আমার প্রাণের ধন লোভে সে রমণী?
          চল,সখি,শীঘ্র যাই,
                    পাছে মাধবে হারাই,—
মণিহারা ফণিনী কি বাঁচে লো স্বজনি?

সাগর উদ্দেশে নদী
           ভ্রমে দেশে দেশে,রে,
অবিরাম গতি—
গগনে উদিলে শশী,
                    হাসি যেন পড়ে খসি,
         নিশি রূপবতী;
    আমার প্রেম-সাগর,
                     দুয়ারে মোর নাগর,
তাবে ছেড়ে রব আমি?ধিক্ এ কুমতি!
         আমার সুধাংশু নিধি—
                     দিয়াছে আমায় বিধি—
বিরহ আঁধারে আমি?ধিক্ এ যুকতি!

নাচিছে কদম্বমূলে,
               বাজায়ে মুরলী,রে,
        রাধিকারমণ!
চল,সখি,ত্বরা করি,
               দেখিগে প্রাণের হরি,
         গোকুল রতন!
    মধু কহে ব্রজাঙ্গনে,
               স্মরি ও রাঙা চরণে,
যাও যথা ডাকে তোমা শ্রীমধুসূদন!
      যৌবন মধুর কাল,
               আশু বিনাশিবে কাল,
কালে পিও প্রেমমধু করিয়া যতন।

(ব্রজাঙ্গনা কাব্য)

বংশী-ধ্বনি (Bngshi Dhwoni) কবিতাটি ছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) -এর অন্যান্য কবিতা, গল্প পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।